প্রিন্ট এর তারিখঃ ডিসেম্বর ২৩, ২০২৪, ৬:৩৫ পি.এম || প্রকাশের তারিখঃ নভেম্বর ১৯, ২০২৪, ১:৫৩ পি.এম
অভিযোগের পাহাড় মনিরামপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের বিরুদ্ধে
ডেস্ক রিপোর্ট
রোগীর প্রতি অবহেলা,স্বজনদের সাথে অসাধাচরন,রোগী বেচাকেনা,ইচ্ছামত সেবা দেওয়া,হাসপতালের পিছনে পুরাতন ভবনে নারী কেলেংকারী,মাদকসেবনও বেচাকেনা,আউটসোর্সিং এ নিয়োগ বানিজ্য,হাসপাতালে ঔষধ কম্পানির লোকের দৌরাত্ম সহ বিভিন্ন অভিযোগ পাওয়া গেছে মনিরামপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে।আবার এসমস্ত অভিযোগের ভিত্তিতে ব্যাবস্থা গ্রহন করেও সমাধানে ব্যার্থ বলে জানিয়েছেন মনিরামপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের তত্বাবধায়ক ডাঃ তন্ময় বিশ্বাস।
যশোরের মণিরামপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে কয়েকদিনের অনুসন্ধানে দেখা গিয়েছে- প্রাইভেট চেম্বারে ভাগিয়ে নেয়া হচ্ছে রোগিদের, দেওয়া হচ্ছে অ-প্রয়োজনীয় পরিক্ষা-নিরিক্ষা ও ঔষধ। স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে রোগি দেখছেন ডাক্তার পেছনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায় প্রাইভেট ল্যাব ও ঔষধ কোম্পানির প্রতিনিধিদের। টেস্ট দিয়ে বলা হয় এনার সাথে যান অথবা সংকেত দেওয়া হয়। ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে রোগী বের হওয়ার সাথে সাথে ঔষধ কম্পানির লোকেরা ঘিরে ধরেন,প্রেসক্রিপশন নিয়ে হয় কাড়াকাড়ি।কার ঔষধ কয়টা লিখেছেন ভিতরের অবস্থানরত ডাক্তার এটাই হলো মূল বিষয়।এহেন আচরণের কারণ জানতে চাইলে কোম্পানির লোকেরা বলেন, আমাদের কোম্পানি থেকে ডাক্তারদের মাসিক টাকা দেওয়া হয়। এজন্য আমাদের বুঝে নিতে হয় ডাক্তারেরা আমাদের ঔষধ লিখেছেন কিনা।
স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নাম মাত্র হাজিরা শেষে বেসরকারি ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক সেন্টারে লক্ষ টাকার মুনাফা লুটছে অসৎ সিন্ডিকেট ও ডাক্তাররা। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সাধারণ মানুষ। সরকারি হাসপাতালগুলোর বেহাল অব্যবস্থাপনার কারণেই এমন সিন্ডিকেটের সূচনা হয়েছে। বর্তমান সরকারের উচিত, সরকারি স্বাস্থ্যসেবা উন্নত করে এসব সিন্ডিকেট নির্মূল করা।
অভিযোগ সূত্রে ও অনুসন্ধানে পাওয়া যায়, ডাক্তারের নিধারিত প্রতিষ্ঠান ব্যতিত পরীক্ষা নিরিক্ষা না করালে রোগির গার্ডিয়ানদের উপরের চলে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ ও হয়রানি, ফেলে দেওয়া হয় রিপোর্ট। পুনঃরায় পরিক্ষা-নিরিক্ষা করতে বলা হয়, যা স্বল্প আয়ের মানুষের পক্ষে অসম্ভব জুলুম।
প্রাইভেট ক্লিনিক ও ল্যাব থেকে নিয়োগ দেওয়া অল্প বয়সী মেয়েরা ওৎ পেতে থাকে মণিরামপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের বারান্দায়, চেক দেওয়া হয় প্রেসক্রিপশন,টেনে নেওয়া হয় নিয়োগ প্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানে।
মণিরামপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের সামনে ও আশপাশে ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে উঠা মানহীন ও নিম্নমানের, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার। অদক্ষ টেকনিশিয়ান, যাদের নেই সাটিফিকেট। আর এসব প্রতিষ্ঠানগুলো সবই দালাল নির্ভরশীল। লাইসেন্সও সঠিক নেই অনেক প্রতিষ্ঠানের। কমিশন ভিত্তিক দালালরা সরকারি হাসপাতালের রোগীদের ভাগিয়ে নিচ্ছে এসব প্রতিষ্ঠানে।কম টাকায় মানসম্মত পরিক্ষা-নিরিক্ষার নানা প্রলোভনে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে অসহায় সেবা নিতে আসা মানুষেরা, প্রতিনিয়ত যেন জমে উঠেছে রোগী বেচাকেনার হাট। দালালদের সামন রেখে মণিরামপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের এক শ্রেণির দুর্নীতিবাজ চিকিৎসক, নার্স, ওয়ার্ড বয় ও আয়াদের ভয়ংকর চক্র গড়ে উঠেছে। আসলে এর নেপথ্যে কলকাঠি নাড়ছে কারা? দিন শেষে হয় দালালচক্র, সরকারি ডাক্তার ও চুক্তিভিত্তিক কর্মকর্তা কর্মচারীদের নিয়ে ভাগবাটোয়ারা।
পর্যবেক্ষক মহলের তথ্যমতে, মানহীন বেসরকারি হাসপাতাল-ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক রোগী নিতে পারলেই ৩০থেকে ৪০% কমিশন পায় রেফারেন্সকারীরা। যেসব চিকিৎসক, নার্স, ওয়ার্ডবয় কিংবা আয়া এ রোগীকে ভাগিয়ে সেখানে পাঠায় তারা পায় ২০০ থেকে ৩০০ টাকা। এভাবেই নিয়মিত চলছে ‘রোগী বেচাকেনা’।
উল্লেখ্য, রোগী যখন সিরিয়াস অবস্থায় থাকে, তখন তার জন্য বিশেষ ওষুধ, ইনজেকশন, স্যালাইন, অক্সিজেন বা আরও বেশি কিছু সাপোর্ট সিস্টেমের প্রয়োজন। এজন্য রোগীকে দ্রুত মানসম্মত হাসপাতাল বা ক্লিনিকে চিকিৎসা সেবা দেওয়া জরুরি। অথচ এসব রোগীকে দ্রুত যশোর সরকারি হাসপাতালে যাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয় মণিরামপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে।
গ্রামের অসহায় লোকজন শহরে গেলে সেখানেও একই অবস্থা, ওৎ পেতে থাকা সংঘবদ্ধ চক্র তাকে টাকার বিনিময়ে কৌশলে দালালদের হাতে তুলে দেয়। পরে তারা তাদের নিয়ে বেসরকারি হাসপাতাল-ক্লিনিকে বিক্রির জন্য এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় ঘুরতে থাকে। দরদামে পোষালেই তবে রোগী বেচাকেনা করে। এতে মুমুর্ষু রোগীর এক থেকে দেড় ঘণ্টা, কখনো দুই-তিন ঘণ্টা সময় পেরিয়ে যায়। ফলে গুরুতর অসুস্থ রোগী অনেক সময় কষ্ট পেয়ে মৃত্যুর কোলে ঢুলে পড়ে।
রোগী ভাগিয়ে নেয়ার বিষয়ে সাধারণ মানুষের তেমন ধারণা না থাকলেও হাসপাতাল-ক্লিনিক ব্যবসার সঙ্গে জড়িতদের কাছে এটি ওপেন-সিক্রেট। সিভিল সার্জন অফিস ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থার কাছে বিভিন্ন সময় এ সংক্রান্ত শত শত অভিযোগ জমা পড়লেও সংশ্লিষ্ট প্রশাসন এ ব্যাপারে কোনো পদক্ষেপ না নেওয়ায় রোগী বেচাকেনার সঙ্গে জড়িতরা বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। তারা বেসরকারি ও ব্যক্তি মালিকানাধীন হাসপাতালের সেলস অফিসার, মার্কেটিং ম্যানেজার, মার্কেটিং জিএম-এজিএম পদের সাইন বোর্ড লাগিয়ে রোগী ভাগিয়ে আনার মতো জঘন্য কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। তাদের সঙ্গে প্রশাসনের গোপন আঁতাত থাকারও অভিযোগ পাওয়া গেছে।
মণিরামপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে মণিরামপুর রিপোর্টার্স ক্লাবের টিম অনুসন্ধানে যেয়ে কর্মরত ডা.ফরিদুল ইসলামের অনুমতি ছাড়ায় ভিডিও নেওয়াতে এবং পারসোনাল চেম্বার করেন ডক্টরস্ ডায়াগনস্টিক সেন্টারে এই প্রশ্ন করতেই তিনি সাংবাদিকদের উপর উত্তেজিত হয়ে রোগীদের সামনে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করতে শুরু করেন।মূলত এই ডাঃ ফরিদুলের নিজ বাড়ি মনিরামপুর পৌর শহরে হওয়ায় যার তার সাথে এরকম আচরন করেন বলে জানিয়েছেন অনেকে। শুধু তিনিই নন, ডা. রঘুরাম চন্দ্র, ডা. হুমায়ুন রশীদ, ডা. সাইফুল ইসলাম পারসোনাল চেম্বার করেন জিনিয়া প্যাথলজিক্যাল ডায়াগনস্টিক সেন্টারে। ডা. অনুপ কুমার বসু ও ডা. সুখদেব মন্ডল পারসোনাল চেম্বার করেন ল্যাব সাদ্ ডায়াগনস্টিক সেন্টারে।
মেডিক্যাল এসিস্ট্যান্ট শিউলি আরা, মাসুদ হোসেন, মেহেদী হাসান, ইফতেখার রসুল। ডা. দিলরুবা ফেরদৌস ডায়না পারসোনাল চেম্বার করেন যশোরের নোভা হসপিটালে।
গরিব অসহায় পেশেন্টদের স্বাস্থ্যভিতি দেখিয়ে সরকারি হাসপাতালে কর্মরত ডাক্তারেরা পারসোনাল চেম্বারে কনভার্ট করার চেষ্টা করেন বলে একাধিক অভিযোগ রয়েছে ভুক্তভোগীদের।
বলাবাহুল্য, দালালদের এই সিন্ডিকেট মূলত সৃষ্টিই হয়েছে সরকারি হাসপাতালগুলোর বেহাল চিকিৎসা সেবার কারণে। গত ৫০ বছরে দেশের স্বাস্থ্য খাতের বিরুদ্ধে সব থেকে বড় অভিযোগ হচ্ছে ‘অব্যবস্থাপনা’। সত্যিকার অর্থেই দেশে পেশাদার একটি স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা গড়ে ওঠেনি। তৃণমূল থেকে যত ওপরে যাওয়া যায় সর্বত্রই একই দৃশ্য প্রতীয়মান হয়। অধিকাংশ হাসপাতালে এখনো পর্যাপ্ত চিকিৎসক, নার্স ও অন্যান্য জনবল নেই। কোথাও কোথাও যন্ত্রপাতি আছে তো টেকনিশিয়ান নেই। জরুরি বিভাগে একজন জুনিয়র চিকিৎসক ও নাম মাত্র কিছু ওষুধ পাওয়া ছাড়া তেমন সেবা মিলছে না। সরকারিভাবে চিকিৎসা সেবা যেহেতু পর্যাপ্ত নয়, তাই চাহিদার প্রেক্ষাপটে বিভিন্ন জায়গায় মানহীন ও নিম্নমানের হাসপাতাল বা ক্লিনিকগুলো হচ্ছে। আর সাধারণ মানুষ সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা না পাওয়ায় দালাল চক্রের মাধ্যমে সেখানে ভিড় করছে।
প্রসঙ্গত, স্বাস্থ্য খাত অত্যন্ত স্পর্শকাতর একটি বিষয়। ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর ইত্যাদি দেশগুলোতে জনসাধারণ অসুস্থবোধ করলে সর্বপ্রথম তাদের মাথায় আসে সরকারি হাসপাতাল। কারণ রাষ্ট্রীয়ভাবে আগে সরকারি স্বাস্থ্যসেবাকে সেখানে উন্নত ও শক্তিশালী করা হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে তার ঠিক উল্টো পরিস্থিতি। সরকারি হাসপাতালের দুর্ভোগের কথা চিন্তা করলে ভীত হয়ে পড়ে সাধারণ মানুষ। এভাবে চলতে থাকলে রাষ্ট্রীয় স্বাস্থ্য সেবার উপর থেকে আস্থা হারিয়ে ফেলবে জনগণ। বেসরকারি এবং কর্পোরেট সিন্ডিকেট দেশের মানুষের জনস্বাস্থ্য নিয়ে ব্যবসার পসরা সাজিয়ে বসবে।
এ সমস্ত অভিযোগ আমলে নিয়ে টিএসও ডাঃতন্ময় বিশ্বাস বলেন,আমি বেশ কয়েকবার প্রাইভেট ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক মালিক সমিতির সকলকে নিয়ে এ বিষয়ে হুশিয়ারি দিয়েছি এবং আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বললেও আমার কথার মূল্যায়ন হয়নি।তবে ডাঃ ফরিদুল ইসলামের আচরন খুবই দুঃখজনক।তবে অন্যায়কারী যে হোক তাকে ছাড় দেওয়া হবেনা।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উচিত,সরকারি হাসপাতালের স্বাস্থ্য সেবার মান উন্নত ও আধুনিক করা। জনবান্ধব করা। জনগণ যাতে সরকারি হাসপাতালে গিয়ে ভোগান্তিবিহীন এবং স্বল্পমূল্যে পর্যাপ্ত চিকিৎসা গ্রহণ করতে পারে তার ব্যবস্থা করা। দালাল নির্মূল করা। দালালী সিন্ডিকেটের সাথে জড়িত চিকিৎসক, ওয়ার্ড বয়, নার্স, কর্মচারীদের আইনের আওতায় নিয়ে এসে শাস্তি প্রদান করা। এসব দুর্নীতি মনিটরিং, নিয়ন্ত্রন ও নির্মূলের জন্য প্রয়োজন হলে আলাদা জনশক্তি নিয়োগ করা।